এনগঞ্জনিউজএক্সপ্রেস২৪ :
ইংরেজিতে একটি কথা আছে the face is the mirror of the mind অর্থাৎ মুখ’ই মনের আয়না। তার মানে মুখ দেখেই মানুষের মনের অবস্থা বুঝা যায়। রাজনীতির ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনি, কোন্ জেলায় দলের অবস্থা কেমন সেটা জেলাশহর বা মহানগরের অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। ৫ আগষ্টের পর বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা’ই যখন ক্ষণে ক্ষণে রং বদলাচ্ছে তখন বি এন পি নিজেদের মধ্যে বিরোধ মিটিয়ে দলকে সুসংগঠিত করার পরিবর্তে বিভিন্ন জেলায় ব্যাক্তি সার্থে দলের মধ্যে বিভাজন উস্কে দিয়ে দলের ক্ষতি করছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ জেলা অন্যতম। তবে নারায়ণগঞ্জ মহানগর থেকে জেলা কমিটির গ্রহনযোগ্যতা অনেক বেশী ছিল বলে মনে করেন স্থানীয় নেতা কর্মিরা। তাদের মতে জেলা কমিটির সভাপতি হিসাবে গিয়াসউদ্দিনের যোগ্যতা, কর্মতৎপরতা প্রশ্নাতীত হলেও কি কারণে জেলা কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া হলো তা অবশ্যই তদন্তের দাবি রাখে। এদিকে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বি এন পি’র অবস্থা তথৈবচ ! ধারা, উপধারা, বিভক্তি, বিভাজনে জর্জরিত মহানগর বি এন পি’তে কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, ব্রেক ফেইল গাড়ির মতো যে কোন সময় মুখ থুবড়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। এরশাদ পতনের পর ১৯৯১ এর নির্বাচনে এডভোকেট আবুল কালাম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে, মহানগর বি এন পি’তে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে। তার আগে জালাল হাজী এবং হাসান জামালের অনুসারী যারা মহানগরের রাজনীতি করতো তারাও এডভোকেট আবুল কালামের সহচার্যে এসে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বি এন পি’কে পুনরুজ্জীবিত করে তোলেন। ২০০১ সালে সন্মেলনের মাধ্যমে এডঃ আবুল কালাম সভাপতি, নাজির প্রধান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে মহানগর বি এন পি’র সাংগঠনিক কাঠামোকে ঢেলে সাজানোর এক পর্যায়ে সাধারণ সম্পাদক নাজির প্রধান মৃত্যু বরণ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে ১/১১ এর সরকার ক্ষমতায় আসে,এর পর হাসিনার দানবীয় শাসনের কথাতো সবার’ই জানা। এরমাঝে এডঃ আবুল কালাম এবং এ টি এম কামাল এর নেতৃত্বাধীন মহানগর বি এন পি’ও মোটামুটি সুসংগঠিত ছিলো। সর্বশেষ এডঃ শাখাওয়াতকে আহবায়ক এবং এডঃ আবু আল ইউসুফ খান টিপুকে সদস্য সচিব করে আহবায়ক কমিটি ঘোষনার মধ্যে দিয়ে মহানগর বি এন পি’র শতধা বিভক্তির সূচনা হয় বলে মনে করেন স্থানীয়’রা। কমিটি ঘোষনার সাথে সাথে বন্দর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মুকুলের নেতৃত্বে আবুল কাউসার আশা সহ প্রায় অর্ধেক সদস্য পদত্যাগ করে এই কমিটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তাদের অভিযোগ ছিলো আহবায়ক ও সদস্য সচিব দু জন’ই বিতর্কিত ব্যাক্তি। ১৬ সালে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে শাখাওয়াতের দুই কোটি টাকা কেলেঙ্কারির কথা টিপু’ই ফাঁস করেছিল বন্টন বৈষম্যের কারণে। বর্তমানে বৈষম্যহীন বন্টনে দুজন’ই পরিতৃপ্ত ; তাই এখন তারা একে অপরের মিত্র। বোদ্ধা মহলের ধারনা এ দুজনের হাতে মহানগরের নেতৃত্ব তুলে দিয়ে বি এন পি বড্ড বড় ভুল করেছে। তাদের মতে নেতৃত্ব এবং নির্বাচন করতে হলে পারিবারিক ঐতিহ্য, স্থানীয় প্রভাব বলয়, ব্যক্তিগত ভোট ব্যাংক, এবং সর্বোপরি একজন পরিচ্ছন্ন ইমেজের সর্বজন স্বীকৃত সজ্জন ব্যক্তি হতে হয়, যা দু’জনের কারো নেই। দলিয় কর্মিদের মতে আতাউর রহমান মুকুল পদত্যাগ করে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি বরাবরের মতো ওসমান পরিবারের চাটুকারিতার কারণে তিনি দল থেকে বহিস্কৃত হন। তার সাথে কপাল পোড়ে শওকত হাসেম শকু এবং বেশ কয়েকজন মুকুল অনুসারির। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়,কাউন্সিলর শওকতের বহিষ্কারে মহানগর বিএনপি অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি এডঃ তৈমুর আলম খন্দকারের অর্বাচীন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে তার ছোট ভাই উদীয়মান তরুণ নেতা কাউন্সিলর খোরশেদ আলম খন্দকারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও প্রায় অন্ধকার ! অন্যদিকে চেয়ারম্যান মুকুল আর কাউন্সিলার আশা’র মহানগরে অনুপস্থিতি ( যদিও তারা ব্যক্তিগতভাবে দলীয় সব কর্মসূচি পালন করছে ) শাখাওয়াত, টিপু র স্বেচ্ছাচারীতাকে নিষ্কণ্টক করেছে বলে মনে করেন তৃনমুলের নেতারা। তারা আরো বলেন বর্তমানে নেতাকর্মীরা সবাই প্রায় সমবয়সী তাই কারো প্রতি কারো শ্রদ্ধাবোধ নেই, কেউ কারো কথা শোনে না, ব্যানারের সামনে /পিছনে দাঁড়ানো নিয়ে প্রকাশ্যে হাতাহাতি হয়, এ-কারণে প্রবিনের অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের শক্তির সংমিশ্রণে যদি মহানগর কমিটি হতো তাহলে এমন হতশ্রী, পরনির্ভরশীল না-হয়ে, একটা শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে যেতো নারায়ণগঞ্জ মহানগর বি এন পি এমনটাই মনে করেন তারা। মহানগরের এক নেতা বলেন সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট আবুল কালাম যতদিন মহানগরের দায়িত্বে ছিলেন বাইরের কেউ এখানে নাক গলানোর সাহস পায়নি। বর্তমান নেতৃত্বের নৈতিক দুর্বলতা ও অর্থলিপ্সার কারণে আড়াইহাজার থানায় ব্র্যাকেট বন্দি হয়েছে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপি, এবং আমরা হয়েছি আড়াইহাজার থানা নিয়ন্ত্রিত মহানগর বিএনপি’র সদস্য !! আড়াইহাজারের কেন্দ্রীয় দুই নেতা মহানগরে নিজেদের প্রভাব বলয় বিস্তারের চেষ্টার কারণে জটিলতা আরো বাড়ছে। আহবায়ক এক নেতার অনুসারী, তো সদস্য সচিব অন্যজনের ! সম্প্রতি বরিশাল মহানগর বি এন পি’তেও গ্রুপিংয়ের কারণে হামলা পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর আগে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বি এন পি’র সদস্য সচিব টিপু’র অভিযোগ ছিল, মুকুল এবং আশা’র অনুসারিরা তাকে গনপিটুনি দিয়েছে কিন্তু তারা অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ঘটনা মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছে। নেতাকর্মীদের অভিযোগ কেন্দ্রীয় নেতাদের কারণেই তৃনমুলে বিভেদ – বিভক্তি’র বিষবাষ্প দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দলে যদি গনতান্ত্রিক চর্চার অনুশীলন থাকতো তাহলে কেন্দ্র থেকে কমিটি দিত না। কমিটি আনার জন্য স্থানীয় নেতারা কেন্দ্রীয় ভিন্ন ভিন্ন নেতার দারস্থ হয়। সেখানে অর্থ লেনদেনের পাশাপাশি গ্রুপিংয়ের সবক দেওয়ার’ও অভিযোগ রয়েছে। কেন্দ্র বা জেলার তত্বাবধানে সম্মেলনের মাধ্যমে স্থানীয় কাউন্সিলর’দের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিতদের দ্বারা যদি নতুন কমিটি করা হয় তাহলে বর্তমানের বিশৃঙ্খল অবস্থার অবসান হতে পারে বলে মনে করেন তারা। বর্তমানে জনসেবার ব্রত নিয়ে কেউ রাজনীতি করে না, অনেকেই এটাকে পুঁজি বিহীন ব্যাবসার সহজ মাধ্যম মনে করে। এ-কারণে রাজনীতিবিদ’দের বেশীরভাগের’ই কোন নির্দিষ্ট পেশা নেই। আরেক শ্রেনীর রাজনীতিবিদ আছে যারা প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী,তারা রাজনীতি করে ব্যাবসার পরিধি বাড়ানোর জন্য, এরা’ই পরবর্তীতে ব্যাংক ডাকাতির মচ্ছবে মেতে ওঠে। এদের সাথে কর্মিদের সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক থাকেনা, কর্মিদের সাথে সম্পর্ক থাকে কর্মচারীর মতো। অথচ নেতার সাথে কর্মির সম্পর্ক থাকার কথা বন্ধুর মতো। নারায়ণগঞ্জ মহানগর বি এন পি’র শীর্ষ নেতাদের ভাবসাব’ও কর্পোরেট হাউসের C.E.O র মতো। তাই অনেকে মজা করে বলেন ঢাল নাই,তলোয়ার নাই নিধি রাম সর্দার ! এদিকে সাবেক ছাত্রনেতা জাকির খান’কে নিয়ে মহানগরের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। তারা বলেন জাকির খান কারামুক্তির পর যদি তার অতীতের পেশি শক্তি নির্ভর রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন তাহলে মহানগর কেন্দ্রিক বিএনপি’র রাজনীতিতে তিনি বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠবেন। তবে জাকির খানের মুক্তির আগেই তার অনুসারিদের মাঝে যে উন্মাদনা দেখা যাচ্ছে তাতে সাধারণ মানুষ কিছুটা আতঙ্কিত, কারণ বিগত ১৫ বছরের ন্যায় আর কোন ভাই আতঙ্কে ভোগতে চায়না মানুষ। এখন নারায়ণগঞ্জ মহানগরের পাড়া মহল্লায় নতুন করে শোনা যাচ্ছে “আমরা ভাইয়ের লোক ” ( জাকির খানের লোক) তারা বলেন এদের অনেকেই কখনো বি এন পি করেনি, উপরন্তু ফ্যাসিস্টের দোসররা’ও এদের সাথে মিশে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এরা বি এন পি’র পরিচয় না দিয়ে ভাইয়ের লোক পরিচয়েই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। তাদের অধিকাংশই কিশোর, তাদের কাছে রাজনীতি মানে সমাজে ব্যক্তিত্ববান হওয়া নয়, ক্ষমতাবান হওয়া ! নাম প্রকাশ না করার শর্তে মহানগরের এক নেতা বলেন, এদের সংস্পর্শ এড়িয়ে সুধিমহলের আস্থা অর্জন পূর্বক গনজোয়ারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে পারলে আগামীতে জাকির খান নারায়ণগঞ্জ মহানগর বি এন পি’র কর্ণধার হলেও অবাক হবনা।