এনগঞ্জনিউজএক্সপ্রেস২৪ :
সুনসান নিরবতা এ যেন কোন হরর মুভির দৃশ্যপট, চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পোড়া ইট,কাঠের স্তুপ, দরজা জানালা বিহীন পলেস্তারা ওঠানো ভাঙ্গা দেয়ালে ঘেরা ভবনটিতে এখনো পোড়া গন্ধ ! অথচ নিকট অতীতে এটাই ছিল ওসমানী সাম্রাজ্যের রাজদরবার ! এখান থেকেই শাসিত- শোসিত হতো নারায়ণগঞ্জ! তারও আগে এটা ছিল রাইফেল ক্লাব। এক সময় শ্যূটিং প্রশিক্ষণরত ছাত্র/ছাত্রীদের কোলাহলে মুখরিত থাকতো এ ক্লাবটি।এ ক্লাবের ছাত্র-ছাত্রীরা অলিম্পিক সহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নিয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে।
নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাব ভবনটি এখন ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে।বিগত আওয়ামী সরকারের ১৭ বছরে রাইফেল ক্লাবটিকে উত্তরমেরুর রাজনৈতিক অফিস হিসেবে ব্যবহার করা না হলে আজ ভুতুড়ে ভবনে রূপ নিতো না।
৫ আগস্টের পর থেকে খালি পড়ে থাকায় মাদকসেবীসহ নানা অসামাজিক কর্মকান্ডের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। রাইফেল ক্লাব এখন মাদকসেবী ও বখাটেদের আড্ডাখানা হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে।জরাজীর্ণ ভবনটিতে নেই দরজা-জানালা। ভেতরে ঢুকে দেখলে মনে হবে যেন কোনো অন্ধকার এক ভূতুড়ে স্থাপনা।
স্থানীয় ফল বিক্রেতা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন,৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার সঙ্গে সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে বহু মানুষ মারা গেলে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতাও থানায় আগুন ধরিয়ে দেয়। ভবনটির ভেতরে থাকা শ্যূটিং ওয়েপন,শ্যূটিং গিয়ার,বিভিন্ন আসবাব ও সরঞ্জাম ভাসমান মানুষ ও দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে যায়।
ষাটোর্ধ্ব এক নারী জানান, এই ভবনগুলোতে শুধু মাদকসেবী আর বখাটেদের আড্ডাই হয় না, বরং এখানে নারীঘটিত অনৈতিক কর্মকান্ড হয়। তবে এসব সরকারি কর্মকর্তারা দেখেও না দেখার ভান করেন।এখন মাদকসেবী ও বখাটেদের আড্ডাখানা হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে।জরাজীর্ণ ভবন নেই দরজা-জানালা।
ভবনটির দেয়ালের চারিদিকে পুড়ে যাওয়ারূপ ও আগুনের ভয়াবহতার ছাপ এখনো রয়ে গেছে।তিন তলায় টিনশেডেও পোড়া গন্ধ।কোথাও কোথাও কক্ষ গুলো থেকে দেখা যাচ্ছে খোলা আকাশ।লুটে নেয়া হয়েছে শ্যূটিং ওয়েপনসহ মূল্যবান জিনিসপত্র। ভবনটি দোতলায় ঘুমাতে দেখা গেছে ভবঘুরে এক কিশোরকে। জানা গেছে,যে সকল পথ শিশু ড্যান্ডি নেশায় আসক্ত এবং যারা চাষাড়া বিজয়স্তম্ভ ও শহীদ মিনারকে রাতে ঘুমের স্থান হিসেব বেছে নিয়েছিল তারাই এখন রাইফেল ক্লাবকে রাত্রিযাপনের নিরাপদ স্থান হিসেবে ব্যবহার করছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বহু থানায়,স্থাপনায়,সরকারীদলের মন্ত্রী,এমপি এবং নেতার বাড়ীত্ েহামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। শেখ হাসিনা সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনীর গুলিতে বহু সাধারণ জনতা নিহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিক্ষুব্ধ জনতা আগুন ধরিয়ে দেয়।
ঐতিহবাহী নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবটি প্রতিষ্ঠার ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা। নারায়ণগঞ্জ – ৪ আসনের সাবেক এমপি শামীম ওসমান রাইফেল ক্লাবটিকে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার পর থেকেই জাতীয় পর্যায়ে শ্যূটিং প্রতিযোগীতা সাফল্যের অর্জনের বিষয়টি প্রচারের চেয়ে শামীম ওসমানের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃতব্য প্রচারই বেশী হয়েছে।যার কারণে ৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ জনতা রাইফেল ক্লাবে হামলার সুযোগ লুফে নিয়েছে।
জানা যাক রাইফেল ক্লাবটির জন্ম ইতিহাস;
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিকট থেকে লীজ নিয়ে ১৯৫০ সালে নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়।জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত ক্রীড়া সংগঠক মরহুম জালাল উদ্দিন আহমেদ,মরহুম গোলাম রাব্বানী খান,ভাষা সৈনিক মরহুৃম আজগর হোসেন ভূঁইয়াসহ নারায়ণগঞ্জের খ্যাতিমান ব্যক্তিগণ রাইফেল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর রিক্রুটিং সেন্টার ছিল রাইফেল ক্লাব।চাঁদমারি টিলাতে
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে শ্যূটিং প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। ব্রিটিশ যুগের অবসানের পর এ সম্পত্তি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্পত্তিতে পরিণত হয়।
১৯৪৮ সালে আগে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ছিল রাইফেল ক্লাবের পুরাতন ভবন।ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে চাঁদমারি টিলা এলাকায় শ্যূটিং প্রশিক্ষণ দেয়া হতো।পরবর্তিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিকট হতে রাইফেল ক্লাবের পুরাতন ভবন এবং চাঁদমারি টিলা এলাকা লীজ নেয়া হয়। দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও উক্ত লীজ বহাল রাখে।আগামী ২৪ বছর পর্যন্ত মেয়াদ রয়েছে।
রাইফেল ক্লাব হতে গত ৭০ বছরে অলিম্পিক গেমসে অংশ নিয়েছে কাজী শাহানা পারভীন,নিত্য গোপালসহ অনেকে।
স্বাধীনতার পর ১৫ বছর যাবত নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাব শ্যূটিং এ জাতীয় চ্যাম্পিয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে। রাইফেল ক্লাব থেকে হাজারের অধিক শ্যূটার প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রশিক্ষিত হয়। এর মধ্যে বেশীর ভাগই বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত রয়েছেন।ক্লাবটি বেশীর ভাগ শ্যূটারই আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত। নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাব হতে আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়েছে শতাধিক শ্যূটার।
নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের শ্যূটিং বিভাগের সাধারন সম্পাদক ও প্রশিক্ষক কাজী ইমরুল কায়েস এর সাথে এক আলাপচারিতায় জানা যায় নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবে ইতিহাস এবং বিভিন্ন সমস্যার বিশদ বর্ণনা।
তিনি জানান,৫ আগস্টের রাইফেল ক্লাব হতে ২ শতাধিক শ্যূটিং ওয়েপন ও শ্যূটিং গিয়ার লুট হয়েছে।যার অনুমানিক মূল্য ১৫ কোটি টাকা।উদ্বার হয়েছে অনুমানিক ২৫/২৬ টি।
রাইফেল ক্লাবে শ্যূটিং প্রশিক্ষণ বিষয়ে তিনি জানান,শ্যূটিং ওয়েপন থাকলে অন্যত্র জায়গা নিয়ে ছাত্রদের প্রশিক্ষণের দেয়া যেতো।
সংশ্লিষ্টরা রাইফেল ক্লাবের শ্যূটিং বিভাগের ছাত্রদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি বিবেচনা করবেন এমনই প্রত্যাশা করেন কাজী ইমরুল কায়েস।